একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশ স্বাধীন করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ। শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও আইনজীবীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে গড়েছেন ইতিহাস। রক্তক্ষয়ী সেই যুদ্ধে অন্যান্য পেশাজীবীর মতো দেশের আইনজীবীরা ঢেলে দিয়েছেন বুকের তাজা রক্ত। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের ভবন উদ্বোধনের দিনে সেসব শহীদ আইনজীবীর নামফলক দেখতে না পেয়ে আক্ষেপ করেছিলেন খোদ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর দীর্ঘ একে একে কেটে গেছে ৫০টি বছর। অবশেষে বঙ্গবন্ধুর সেই প্রত্যাশা বাস্তবায়ন করেছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।
ইতিহাস পাতা থেকে জানা যায়, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে স্বাধীন নিজ দেশের মাটিতে ফিরে আসেন। পরদিন ১১ জানুয়ারি ‘দি প্রভিশনাল কন্সটিটিউশন অব বাংলাদেশ অর্ডার, ১৯৭২’ জারি করা হয়। ওই আদেশের অনুচ্ছেদ ৯-এ উল্লেখ করা হয় যে, বাংলাদেশে একটি হাইকোর্ট থাকবে—যা একজন প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারপতি যারা সময়ে সময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন তাদের সমন্বয়ে গঠিত হবে।
ওই দিনেই রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বিচারপতি এ এস এম সায়েমকে বাংলাদেশ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় এবং রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতিকে শপথবাক্য পাঠ করান। ১৭ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির ৫ নম্বর আদেশ অর্থাৎ ‘দি হাইকোর্ট অব বাংলাদেশ অর্ডার, ১৯৭২’ জারি করা হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ হাইকোর্ট। রাষ্ট্রপতির ১১৪ নম্বর আদেশ অর্থাৎ ‘দি হাইকোর্ট অব বাংলাদেশ’ (সেকেন্ড অ্যামেন্ডমেন্ট) আদেশ দ্বারা রাষ্ট্রপতির ৫ নম্বর আদেশের কার্যকারিতা দেওয়া হয় ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি থেকে। ১৯৭২ সালের ১৮ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টে আসেন বঙ্গবন্ধু। সেদিন সুপ্রিম কোর্টের ইনার গার্ডেন প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধু উদ্বোধনী ভাষণ দিয়েছিলেন।
ভাষণে নিজের প্রত্যাশার কথা অকপটে তুলে ধরেছিলেন জাতির পিতা। তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমি নিশ্চয়ই সুখী হতাম, যেমন আমি পিজি হসপিটালে গিয়ে দেখি যে এতজন ডাক্তারের নাম, যারা শহীদ হয়েছেন। তাদের নাম লিখে ফলক করে রাখা হয়েছে। আমি সুখী হতাম বারের সদস্য ভাইয়েরা- যে যে সহকর্মীরা, যারা শহীদ হয়েছেন, এই সুপ্রিম কোর্টের গেটে এসে দেখতে পেতাম যে শহীদের নাম সেখানে লেখা রয়েছে, আমি সুখী হতাম।’
সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর সেই প্রত্যাশা পূরণে সচেষ্ট হয়ে ওঠে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। বর্তমান প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে উদ্যোগ নেওয়া হয় বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশা পূরণের। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালের ১৮ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের ইনার গার্ডেনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মারক স্তম্ভের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।
সম্প্রতি সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, স্মারক স্তম্ভে ১৯৭২ সালের ১৪ ডিসেম্বর সংবিধানে স্বাক্ষররত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি এবং ১৯৭২ সালের ১৮ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে বক্তৃতার ছবি মুর্যাল হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর ওপর নির্মিত স্মারক স্তম্ভে সংবিধানের প্রস্তাবনা এবং সংবিধানের ৯৪ এবং ৯৫ অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশা অনুযায়ী স্মারক স্তম্ভে স্থান পেয়েছেন মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া ৬৯ আইনজীবী। তারা হলেন, যশোরের এম মশিউর রহমান, কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, পাবনার মুহাম্মদ আমিন উদ্দিন, ঢাকার আবদুল আহাদ, এ কে এম সিদ্দিক (হেনা মিঞা), খন্দকার আবু তালেব, দীনেশ চন্দ্র রায় মৌলিক, মো. মফিজুর রহমান, সৈয়দ আকবর হোসেন (বকুল মিয়া), দেওয়ান মাহবুব আলী, বাবু লাল মোহন শিকদার, মোহাম্মদ ইছহাক, চট্টগ্রামের রায় সাহেব কামিনী কুমার ঘোষ, আবুল হোসেন, নজমুল হক সরকার, বীরেন্দ্রনাথ সরকার, মোহাম্মদ তসলিম উদ্দিন, গোলাম মোস্তফা খান, খুলনার আবদুল জব্বার, এস এম আইয়ুব হোসেন ও আবদুর রহিম, সিলেটের মো. আব্দুল হাফিজ, রামরঞ্জন ভট্টাচার্য্য, বরিশালের জিতেন্দ্রলাল দত্ত, সুধীর কুমার চক্রবর্তী, রংপুরের এ ওয়াই মাহফুজ আলী (জররেজ মিয়া), পূর্ণচন্দ্র সরকার, শিবেন্দ্রনাথ মুখার্জি, বিজয় চন্দ্র মিত্র, নারায়ণগঞ্জের অখিল চন্দ্র দাস, মো. ফজলুল হক, মুন্সীগঞ্জের অনিল চ্যাটার্জী, নারায়ণ চন্দ্র মন্ডল, মন্মথ মুখার্জি, কেদার রায় চৌধুরী, ফরিদপুরের জিতেন্দ্রনাথ সেন এবং রাজবাড়ীর কালীশঙ্কর মৈত্র, কক্সবাজারের জ্ঞানেন্দ্রলাল চৌধুরী ও বৌধেন্দ্র বিকাশ ভট্টাচার্য।