*শিশু হুমায়ন কবির এর শিক্ষাগত যোগ্যতা কি বেতাগী বাসী জানতে চায়?
*জিয়া শিশু একাডেমি করে শতশত কোটি টাকার মালিক কিভাবে?
*হুমায়ন কবির বিএনপির কি দায়িত্বে আছে বেতাগীবাসী জানতে চায়?
স্টাফ রিপোর্টার
বরগুনার পুলিশ সুপার (এসপি) ইব্রাহিম খলিলের ভাই হুমায়ুন কবির। তিনি ‘জিয়া শিশু একাডেমির মহাপরিচালক পরিচয়ে এলাকায় বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে নেমেছেন। ক্ষমতার অপব্যবহার ও প্রভাব বিস্তার করছেন বিভিন্ন দপ্তর-অধিদপ্তরে। এসপির বড় ভাই হিসাবে এলাকায় গেলে পাচ্ছেন ভিআইপি প্রটোকল। পুলিশ এসকর্ট দিতে উপস্থিত থাকেন খোদ বেতাগী থানার ওসি একরামুল হক। বিষয়টি নিয়ে চাঞ্চল্যের পাশাপাশি নানা গুঞ্জন চলছে স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে।
সে সবার কাছে বলে বেড়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখা পড়া করেছে কিন্তু এলাকার মানুষ জানে তার নানা বাড়ি থেকে মাদ্রাসায় লেখা পড়া করেছে। অভাবের তাড়নায় দাখিল পাস করার আগেই কাজের সন্ধানে ঢাকায় আসে। যেহেতু তার মাকে তার বাবা ডিভোর্স দিয়েছে সে কারণে তার নানা বাড়ি থাকা।
এদিকে, পতিত সরকারের দোসর হিসাবে পরিচিত অনেককেই আশ্রয়-প্রশ্রয়ও দিচ্ছেন তিনি। এদের মধ্যে বেতাগী উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান, পৌর মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম গোলাম কবীরের নামও আছে। এলাকায় ‘ফিফটিন পার্সেন্ট’ হিসাবে পরিচিত এই ব্যক্তিদের নিয়ে ঢাকায় গোপন বৈঠকও করেছেন। আওয়ামী লীগের এই দুই নেতার বিরুদ্ধে স্থানীয় গণমিলনায়তন নির্মাণে পুকুর চুরির তদন্ত শুরু হয়েছে। গত ১৫ বছরে শত শত কোটি টাকার কমিশন বাণিজ্যের এই হোতাদের মামলায় আসামি না করার অভয় দিয়ে হুমায়ুন হাতিয়েছেন বিপুল টাকা। নিয়েছেন নতুন বিলাসবহুল গাড়ি। অনুসন্ধানে মৎস্য আড়তে চাঁদাবাজি, আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক, এলাকায় পুলিশ এসকর্টের ভিডিওসহ নানা তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। আরোও জানাযায়,
জানতে চাইলে বরগুনার এসপি ইব্রাহিম খলিল বলেন, ‘আমি যতদূর জানি ২০০৬ সালের আগে আমার ভাই এলাকায় এলে এখনকার চেয়েও বেশি প্রটোকল পেতেন। তখন ডিসি, এসপিরা যেতেন। আমি তো একদিনও যাইনি। আমার জন্য এখানকার পোস্টিংটা বিব্রতকর। আমি সব বিষয়েই তাকে এড়িয়ে চলি। আমার জন্য তার কার্যক্রমে সুবিধার চেয়ে অসুবিধা বেশি হচ্ছে।’ তিনি কি এলাকায় পুলিশ প্রটোকল পাওয়ার যোগ্য কিনা এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তিনি পুলিশ প্রটোকলে এলাকায় এসেছেন এমন তথ্য আমার জানা নেই।’ পলাতক আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে হুমায়ুন কবীরের বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এরকম একটি ছবি আমার কাছেও এসেছে। তবে ওই বৈঠকে যে তিনি (হুমায়ুন) আওয়ামী লীগ নেতাদের আসামি না করার আশ্বাস দিয়েছেন তা প্রমাণ করে না।’
অনুসন্ধানকালে এ প্রতিবেদকের আলাপ হয় বেতাগী উপজেলা প্রশাসনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে। হুমায়ুন কবিরকে পুলিশ প্রটোকল দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে তিনি বলেন, ‘হুমায়ুন কবির যখন ঢাকা থেকে এলাকায় আসেন তখন থানার ওসির ব্যস্ততায় মনে হয় কোনো ভিআইপির প্রটোকলের ব্যবস্থা করতে তিনি মরিয়া হয়ে উঠেছেন। ওসির কারণে হুমায়ুন কবীর উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ওপরও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেন। এটা আসলে দৃষ্টিকটু। বিষয়টির সুরাহা হওয়া উচিত।’
এসব বিষয়ে জানতে বেতাগী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) একরামুল হকের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
জানা গেছে, বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ‘জিয়া শিশু একাডেমি’ নামের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন হুমায়ুন। ওয়ান ম্যান-শো হিসাবে পরিচিত এই সংগঠনের সুবাদে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পান। তখন থেকেই তিনি এলাকায় প্রভাব বিস্তার করতেন। আওয়ামী শাসনামলে তাকে এলাকায় কেউ দেখেননি। ৫ আগস্ট স্বৈরশাসনের পতনের পর বরগুনায় এসপি হিসাবে যোগ দেন তার বৈমাত্রেয় (সতালো) ছোট ভাই ইব্রাহীম খলিল। এরপরই হঠাৎ ভিআইপি প্রটোকল নিয়ে এলাকায় আবির্ভূত হন হুমায়ুন। এলাকাবাসী বলেছেন, বড় ভাইয়ের পুলিশ প্রটোকলের পেছনে আছেন ছোট ভাই।
বেতাগী থানার এক এসআই নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘হুমায়ুন কবীর তার মায়ের নামে ‘নূরজাহার আইডিয়াল’ স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এই স্কুলের নামকরণে পরিবর্তন আনা হয়। এবার মা ‘নূরজাহান’ বাদ দিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নাম বসিয়ে উদ্বোধনের প্রক্রিয়া করছেন। এই স্কুলের নামে বিভিন্ন মহল থেকে আদায় করা হচ্ছে চাঁদা। বিষয়টি আসলে খুবই স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছে। একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নাম এভাবে স্কুলের সঙ্গে সংযুক্ত করে সাধারণ মানুষের কাছে টাকা চাওয়ার বিষয়টি গ্রামের লোকজন ভালোভাবে নিচ্ছেন না। স্কুলটি যেখানে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সেটা বিষখালী নদীর পাড়ে। এলাকার নাম মোকামিয়া খালগোড়া।
প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তে দেখা গেছে, বিষখালী নদীতে ইলিশ মাছ ধরেন এমন এক জেলের কাছ থেকেও ৪২ কেজি মাছ ও নগদ টাকা চাঁদা আদায় করেছেন হুমায়ুন। তার চাঁদাবাজি এখন বিভিন্ন দপ্তর-অধিদপ্তর থেকে নদী তীর পর্যন্ত বিস্তৃত। এ নিয়ে পুলিশের পাশাপাশি উপজেলা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে অস্বস্তি থাকলেও প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলছেন না। কারণ তার ছোট ভাই জেলার এসপি।
হুমায়ুন কবীরের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিসহ ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ জমা পড়েছে দলীয় হাইকমান্ড ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে। বেতাগী উপজেলার মোকামিয়া ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক নাইম মাহমুদ রিয়াজ এই অভিযোগ জমা দেন। আওয়ামী স্বৈরশাসনের পুরো সময় ফেরারি জীবন কাটানো বিএনপি নেতা নাইমের কাছেও চাঁদা দাবি করেন হুমায়ুন।
জানতে চাইলে নাইম মাহমুদ রিয়াজ বলেন, ‘বিগত সরকারের আমলেও আমি নির্যাতনের শিকার হয়েছি। পুলিশের সাজানো মামলার ভয়ে ছিলাম ফেরারি। আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ায় এখন আমাকেও চাঁদাবাজির টার্গেট বানানো হয়েছে। চাঁদা না দিলে মামলা দিয়ে জেলে দেওয়ার হুমকিও দিচ্ছেন। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে প্রধান উপদেষ্টা, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও পুলিশের আইজির কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি।
অভিযোগে বলা হয়েছে, হুমায়ুন কবিরকে এখনই প্রতিরোধ করা না হলে বিএনপির ত্যাগী নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের চেয়ে আরও বেশি নির্যাতনের শিকার হবে। তার চাঁদাবাজি, লুটপাট, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে দলীয় ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে। সন্ত্রাস এবং দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও দলের নীতি, আদর্শ ও সংহতি পরিপন্থি নানা অনাচারের বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি করে দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়।
অভিযোগে আরও বলা হয়, তৎকালীন (২০০১-২০০৫) বিএনপি শাসনামলে বাংলাদেশ জিয়া শিশু একাডেমির মহাপরিচালক এম হুমায়ুন কবির নিজের মায়ের নামে নূরজাহান আইডিয়াল গার্লস স্কুল অ্যান্ড কৃষি কলেজ উদ্বোধন করেন। কিন্তু ২০০৮ পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে স্কুলের কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এম হুমায়ুন কবির কখনো নিজ এলাকা মোকামিয়াতে আসেননি। ২০২৩ সালের ২২ মার্চ হুমায়ুন কবির তার মায়ের নামে নূরজাহান আইডিয়াল গার্লস স্কুল অ্যান্ড কৃষি কলেজের উদ্বোধন করলেও সম্প্রতি কলেজের নাম পরিবর্তন করে খালেদা জিয়া গার্লস স্কুল অ্যান্ড কৃষি কলেজ রাখেন। এরপর এই কলেজ উন্নয়নের নামে শুরু করা হয় চাঁদাবাজি। ছোট ভাই বরগুনার এসপি হওয়ায় এসব কর্মকাণ্ড অনায়াসে ‘জায়েজ’ করে নিচ্ছেন। বরগুনা জেলাসহ বেতাগী উপজেলায় বিএনপির কমিটি না থাকায় সাংগঠনিকভাবে প্রতিরোধ বা প্রতিবাদ করার মতো কেউ নেই। আবার পুলিশি হয়রানির ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস করেন না।
প্রাপ্ত রেকর্ডমতে, অভিযোগকারী রিয়াজের নম্বরের হোয়াটসঅ্যাপে কল করে হুমকি দেন হুমায়ুন। বলেন, মোকামিয়া বাজারে ব্যবসা করতে হলে ১০ লাখ টাকা দিতে হবে। ছোট ভাইয়ের চাকরি রক্ষা করতে হলে আরও ২০ লাখ টাকা দাবির অভিযোগও আছে। এছাড়াও নদীতে মাছ ধরা জেলেদের থেকে মাছসহ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। হুমায়ুনের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। স্থানীয় দুর্গাপূজায় অনুষ্ঠানের নামে ঢাকা থেকে বাউল শিল্পী এনে মন্দির থেকেও টাকা নিয়েছেন। মন্দির পরিদর্শনের নামে বেতাগী থানার পুলিশের গাড়ি ব্যবহার করে বিশাল মোটর শোভাযাত্রা করা হয়। পুলিশের এই প্রটোকলসহ শোডাউন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়ে।
জানতে চাইলে হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘আমার সুনাম নষ্ট করতে একটি মহল অপপ্রচার চালাচ্ছে। আমি নির্বাচন করব এমনটা ধরে নিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের লোকজন আমার ভাইয়ের সঙ্গে আমার নাম জড়িয়ে নানা বানোয়াট তথ্য ফেসবুকে দিচ্ছে। আমাদের স্থায়ী ঠিকানা পটুয়াখালী। আমরা সেখানেই বড় হয়েছি। পরে বরগুনোর চলে আসি। সম্প্রতি আমার ভাই বরগুনার এসপি হিসাবে যোগ দেওয়ার পর বিতর্ক এড়াতে আমি তার বাসায় যাওয়াই বাদ দিয়েছি। পুলিশের কোনো কাজে আমার তার কাছে যেতে হয় না। আমি সরাসরি ডিআইজির সঙ্গেই কথা বলি।’ আপনি পুলিশ প্রটোকল পাওয়ার যোগ্য কিনা-কিংবা আপনাকে যে পুলিশ প্রটোকল দেওয়া হয়েছে সেটা আইনসম্মত মনে করেন কিনা-জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি আমার নিরাপত্তার জন্য পুলিশের সহায়তা চাইতেই পারি। তাছাড়া পূজার সময় আমি তারেক রহমান সাহেবের পক্ষ থেকে এলাকায় মন্দিরে মন্দিরে গিয়ে সহায়তা দিয়েছি। তখন পুলিশ সদস্যরা সঙ্গে ছিলেন। এটাকেই অন্যভাবে প্রচার করা হচ্ছে।’ স্কুলের নাম পরিবর্তন করে আপনি চাঁদাবাজি করছেন কিনা-এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্কুলে নাম আরও ২ বছর আগে পরিবর্তন করা হয়েছে। ফখরুল সাহেব ওটা উদ্বোধন করেছেন। মাছের আড়ত থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগ ঠিক নয়।’ আওয়ামী নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমি একটি দাওয়াতে গিয়েছিলাম। ওই দাওয়াতে বিএনপির আরও অনেক নেতা ছিলেন। এখন তারা আমার টেবিলে এসে বসলে আমি তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। সৌজন্যতার কারণেই তাদের সঙ্গে কথা বলতে হয়েছে।