• রবিবার, ১০ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৫৬ অপরাহ্ন

না ফেরার চেয়ে দেরিতে ফেরা উত্তম;সড়ক দুর্ঘটনা

স্বাধীন ভোর ডেস্ক / ১০০ বার দেখা হয়েছে
প্রকাশের সময় মঙ্গলবার, ১৩ জুন, ২০২৩

ইদুল হাসান ফারহান,

বর্তমান সময়ের আলোচিত ও মর্মস্পর্শী ঘটনা হলো সড়ক দুর্ঘটনা। এ দুর্ঘটনায় প্রতিদিন হারিয়ে যাচ্ছে হাজারো মানুষের প্রাণ। ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে হাজারো স্বপ্ন, নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে পরিবার। সড়ক দুর্ঘটনা বর্তমানে আমাদের সৃষ্ট স্বাভাবিক জীবনযাপনের ক্ষেত্রে একটি জাতীয় সমস্যা এবং নিরাপত্তার প্রধান হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মৃত্যু অনিবার্য, কেউ তা থামাতে পারবে না। তবে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু যেন মেনে নেওয়া যায় না। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন জায়গায় সড়ক দুর্ঘটনায় ঝড়ে যাচ্ছে অসংখ্য তাজা প্রাণ। দুর্ঘটনা আকস্মিক এবং তা প্রতিদিন ঘটে না, এমন কথা এখন আর খুব একটা মানানসই না। প্রতিদিনই খবরের কাগজে ভেসে উঠছে বীভৎস সব লাশের ছবি। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হচ্ছে, আবার কেউবা পঙ্গুত্ব বরণ করছে। সড়ক দুর্ঘটনার খবর যেন আমাদের গা-সহা হয়ে গেছে। একটি দুর্ঘটনা একটি পরিবারের সারা জীবনের কান্না। এই আকস্মিক সড়ক দুর্ঘটনা ছিনিয়ে নেয় পরিবারের একমাত্র আশা অন্ন-বস্ত্রের সংস্থানকারীকে। যে মানুষটি ছিল পরিবারের একমাত্র অবলম্বন, সড়ক দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু সেই পরিবারের অন্য সদস্যদের সব স্বপ্ন-আশা-আকাঙ্ক্ষা ভেঙে চুরমার করে দেয়। তাদের ভবিষ্যৎ হয়ে পড়ে অনিশ্চিত। নিহতের স্বজনদের আর্তচিৎকার আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করলেও তা যেন আমাদের বিবেককে নাড়া দিতে পারছে না। কিন্তু আমরা কি একবারের জন্যও ভেবে দেখি নিহতদের পরিবারের কথা? তারা কি ভুলতে পারে তাদের স্বজন হারানোর কথা? বেসরকারি সংস্থা রোড সেফটি ফাউন্ডেশন ৯টি জাতীয় দৈনিক, ৭টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে যে, গত মে মাসে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪৯১টি। নিহত ৪০৮ জন এবং আহত ৬৩১ জন। নিহতের মধ্যে নারী ৬৭, শিশু ৭৮ জন। ১৫৬টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ১৪১ জন, যা মোট নিহতের ৩৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৩১ দশমিক ৭৭ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ১০৪ জন পথচারী নিহত হয়েছে, যা মোট নিহতের ২৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৭২ জন, অর্থাৎ ১৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ। প্রতিবেদনে বলা হয়, মে মাসে ৬টি নৌ-দুর্ঘটনায় ৪ জন নিহত ও ২ জন নিখোঁজ রয়েছেন। ২৫টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ২৩ জন নিহত এবং ৬ জন আহত হয়েছে। দুর্ঘটনায় যানবাহনভিত্তিক নিহতের পরিসংখ্যানে দেখা যায়— মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী ১৪১ জন (৩৪ দশমিক ৫৫%), বাসযাত্রী ৬ জন (১ দশমিক ৪৭%), ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ-ট্রাক্টর-ট্রলি-লরি-ট্যাঙ্কার আরোহী ৩৬ জন (৮ দশমিক ৮২%), প্রাইভেটকার-মাইক্রোবাস-অ্যাম্বুলেন্স আরোহী ১৮ জন (৪ দশমিক ৪১%), থ্রি-হুইলার যাত্রী (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-মিশুক) ৬৮ জন (১৬.৬৬%), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহনের যাত্রী (নসিমন-করিমন-মাহিন্দ্র-ইটভাঙ্গা মেশিন গাড়ি) ১৫ জন (৩ দশমিক ৬৭%) এবং বাইসাইকেল-প্যাডেল রিকশা-রিকশাভ্যান আরোহী ২০ জন (৪ দশমিক ৯০%) নিহত হয়েছে। দুর্ঘটনা সংঘটিত সড়কের ধরন বিশ্লেষণে বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ১৬৫টি (৩৩ দশমিক ৬০%) জাতীয় মহাসড়কে, ২০১টি (৪০ দশমিক ৯৩%) আঞ্চলিক সড়কে, ৭৩টি (১৪ দশমিক ৮৬%) গ্রামীণ সড়কে, ৪৮টি (৯ দশমিক ৭৭%) শহরের সড়কে এবং অন্যান্য স্থানে ৪টি (০ দশমিক ৮১%) সংঘটিত হয়েছে। দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের মধ্যে- ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ-ট্রাক্টর-ট্রলি-লরি-ড্রামট্রাক-তেলবাহী ট্যাঙ্কার ২৯ দশমিক ২০%, মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার-অ্যাম্বুলেন্স-পাজেরো ৫ দশমিক ১২%, যাত্রীবাহী বাস ১৩ দশমিক ৬৭%, মোটরসাইকেল ২৩ দশমিক ৭৮%, থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-বেবিট্যাক্সি-মিশুক) ১৬ দশমিক ৬৬%, স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন (নসিমন-করিমন-ভটভটি-চান্দের গাড়ি-টমটম-মাহিন্দ্র-ডাম্পার-লোবেট-ইটভাঙ্গার মেশিন গাড়ি-ধানমাড়াই গাড়ি) ৪ দশমিক ২৭%, বাইসাইকেল-প্যাডেল রিকশা-রিকশাভ্যান ৩ দশমিক ৮৪% এবং অজ্ঞাত গাড়ি ৩ দশমিক ৪১%। দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকা বিভাগে দুর্ঘটনা ২৭.২৯%, প্রাণহানি ২৫%, রাজশাহী বিভাগে দুর্ঘটনা ১৪.৪৬%, প্রাণহানি ১২.৯৯%, চট্টগ্রাম বিভাগে দুর্ঘটনা ১৭.৩১%, প্রাণহানি ১৭.৬৪%, খুলনা বিভাগে দুর্ঘটনা ১৪.০৫%, প্রাণহানি ১৬.১৭%, বরিশাল বিভাগে দুর্ঘটনা ৫.৪৯%, প্রাণহানি ৪.৯০%, সিলেট বিভাগে দুর্ঘটনা ৪.২৭%, প্রাণহানি ৬.৩৭%, রংপুর বিভাগে দুর্ঘটনা ৭.৯৪%, প্রাণহানি ৭.৮৪% এবং ময়মনসিংহ বিভাগে দুর্ঘটনা ৯.১৬%, প্রাণহানি ৯.০৬% ঘটেছে। ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। ১৩৪টি দুর্ঘটনায় ১০২ জন নিহত। সিলেট বিভাগে সবচেয়ে কম ২১টি দুর্ঘটনা এবং বরিশাল বিভাগে সবচেয়ে কম ২০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। একক জেলা হিসেবে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি ২৯টি দুর্ঘটনায় ২৩ জন নিহত হয়েছে। সবচেয়ে কম শরীয়তপুর ও রংপুর জেলায়। এই ২টি জেলায় সামান্য মাত্রার ৭টি দুর্ঘটনা ঘটলেও কোনও প্রাণহানি ঘটেনি। বিশেষত রাজধানী ঢাকায় ২৬টি দুর্ঘটনায় ১৮ জন নিহত ও ৪৩ জন আহত হয়েছে।আমাদের দেশে অধিকাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে আমাদের অসচেতনার অভাবে। এর মধ্যে প্রধান কারণগুলো হলো- ট্রাফিক আইন অমান্য করা, চালকের অসতর্কতা, অসচেতনতা, বেপরোয়া বা অনিয়ন্ত্রিত গতিতে গাড়ি চালনা, ত্রুটিপূর্ণ রাস্তা দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। এ ছাড়া চালকরা অনেক সময় ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত অবস্থায় গাড়ি চালায়, যার ফলে একসময় নিজের অজান্তেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে। এ দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ ওভারটেকিং প্রবণতা। সাধারণত রাস্তায় ধীরগতির গাড়িগুলোকে ওভারটেকিংয়ের প্রয়োজন পড়ে। এ সময় হর্ন বাজিয়ে সামনের গাড়িকে সংকেত দিতে হয়। কিন্তু অনেক সময় সংকেত না দিয়ে একজন আরেকজনকে ওভারটেক করার চেষ্টা করে, যার ফলে সামনের দিক থেকে আসা গাড়ি বের হতে না পেরে মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। সড়ক দুর্ঘটনার আরেকটি কারণ হল ত্রুটিপূর্ণ সড়কব্যবস্থা। মহাসড়কগুলোতে বাঁক থাকার কারণে সামনের দিক থেকে আসা গাড়ি দেখতে না পেয়ে অনেক চালক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে থাকে। রাস্তার পাশে হাট-বাজার স্থাপন এবং ওভারব্রিজ না থাকাও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। সড়ক দুর্ঘটনার একটি বড় কারণ হল মহাসড়কগুলোতে দ্রুতগতির যানবাহনের পাশাপাশি ধীরগতির যানবাহন চলাচল। গতির তারতম্য থাকায় দ্রুতগতির গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লেগে ধীরগতির বাহন রাস্তা থেকে ছিটকে যাওয়া। এই মর্মান্তিক দূর্ঘটনা এড়াতে আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নিজেরা সচেতন হওয়া এবং অন্যদের মাঝে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা। এমন পরিস্থিতিতে কয়েকটি বিষয় গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করলে সড়ক দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব।
১. গাড়ি চালানোর সময় ড্রাইভিংয়ে মনোযোগী হওয়া এবং রাস্তার দিকে লক্ষ্য রাখা।
২.নিরাপদ ড্রাইভিংয়ের জন্য রাস্তা বিশ্লেষণ বা রোড স্ক্যানিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গাড়ি চালানোর সময় রাস্তা-সম্পর্কিত কিছু বিষয় লক্ষ্য রাখা সেগুলো হলো- রাস্তায় গাড়ির পরিমাণ, রাস্তার লেনের পরিমাণ, রাস্তার গঠনগত অবস্থা, রাস্তার প্রশস্ততা।
৩.সঠিক নিয়মে সিট বেল্ট বাধা। কারণ সিট বেল্ট বেঁধে গাড়ি চালানো এবং গাড়িতে চড়া দুটোই নিরাপদ ড্রাইভিংয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
৪.গাড়ি চালানোর সময় কখনই হুটহাট করে গাড়ির গতিসীমা বাড়ানো বা কমানো যাবে না। কারণ হুটহাট গাড়ির গতি বাড়ানো বা কমানো প্রায়শই বড় দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
৫. অনেক সময় প্রতিযোগিতা করে অনেক ড্রাইভার গাড়ি চালিয়ে থাকেন। এটি একটি বিকৃত চিন্তা এবং সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।
৬.গাড়ি চালানোর সময় চালক নেশাগ্রস্ত থাকার কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। তাই নেশাগ্রস্ত অবস্থায় কখনোই গাড়ি চালাবেন না।
৭.অল্প দক্ষ চালক দিয়ে কখনোই গাড়ি চালানো ঠিক নয়। কারণ বেশি দুর্ঘটনা ঘটে থাকে অদক্ষ চালকের জন্য। তাই এক্ষেত্রে গাড়ির মালিকদের সচেতন হতে হবে।

সড়ক দুর্ঘটনা এখন শুধু নিছক কোনও দুর্ঘটনা নয়। বরং অনেকাংশেই এটা দুর্যোগের পর্যায়ে চলে গেছে। তাই সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ। সরকার, চালক, মালিক, শ্রমিক ও যাত্রী সবাইকে সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা যেন সড়ক দুর্যোগে রূপ না নিতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে, না ফেরার চেয়ে দেরিতে ফেরা উত্তম ।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও সংবাদ